জীবন জিজ্ঞাসা(প্রেমের গল্প)


কলেজের বন্ধু অনীক আর অনন্যা । অনন্যা দু বছরের জুনিয়র । ওদের আলাপ হয় ক্যান্টিনে । অনন্যা একদিন ক্যান্টিনে বন্ধুদের সাথে খাচ্ছিল । অনীক ছিল ইউনিয়নের লিডার । ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র । ক্যান্টিনে বন্ধুরাই আলাপ করিয়ে দেয় অনন্যার সাথে । তারপর হইহই করে এক বছর কেটে গেলো । নাহ, সময় টা মোবাইল ফোনের জমানা নয় । অনীকের নাম্বার নেওয়া হয়নি অনন্যার। অনীক পাশ করে বেরিয়ে গেছে কলেজ থেকে । ওদের বাড়ির কাউকে চেনেনা অনন্যা । এইভাবেই দিনগুলো কেটে গেলো । কোথায় যেন হারিয়ে গেলো অনীক ।

খুব ভালো নাচ করতো অনন্যা । কলেজের প্রায় সকল কালচারাল শো তে অংশ গ্রহন করতো অনন্যা ।বি এ পাশ করে নাচের স্কুল ও খুলেছিল । তারপর হঠাৎ ই সব এলোমেলো হয়ে গেলো একটা এক্সিডেন্টে । ডান পা বাদ যায় অনন্যার । এখন তার বয়স ৪০ । স্ক্র্যাচ নিয়ে চলে সে।  অনন্যার বাবা মা ছিল না । মামা মামীর কাছেই মানুষ হয় সে । মামার মেয়ে অরুনা ওরই বয়সি । অনন্যা বিয়ে করে নি । একাই আছে । মামী মা মারা গেছেন । মামা বুড়ো হয়েছেন । অরুনার বিয়ে হয়ে গেছে বিদেশে । নাচের স্কুল ও বন্ধ । মামা বাবুর পেনশন এর টাকায় দিন চলে ওদের ।

 " অনীক এখন কেমন আছে? অনন্যা তাকে ভোলে নি । সে নিশ্চই অনন্যা কে ভুলে গেছে ? সে কি চিনতে পারবে যদি দেখা হয় অনন্যার সাথে?"-এইসব একরাশ কথা ভাবছিল অনন্যা । একাকী জানালার ধারে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সে । কেনও যেন আজ রাত্রে ঘুম আসেনি  তার ।পুরনো সব স্মৃতির রোমন্থন করছিলো সে । তার যখন ৩০ বছর বয়স তখন একটা বাস এক্সিডেন্টে পা বাদ যায় । ব্যাস , নাচ বন্ধ । পরের দশ বছর দম বন্ধ করে কেটে গেছে । মামীমাও চলে গেলেন ৫ বছর হোল । অরুনা ফোন করে মাঝে মাঝে ।

মামার বাড়ির একতলার হল ঘরে বেশ ৩০ জন মত ছাত্র ছাত্রী নিয়ে স্কুল ছিল তার । কিন্তু পা বাদ যাওয়ার পরে আর নাচতে পারে নি সে । ছাত্র রাও এক এক করে ছেড়ে চলে গেছে তাকে । এখন নাচের বই পড়েই সময় কাটে তার । সে ভাবে পরের জন্মে নিশ্চই নাচ আর অনীক কে ফিরে পাবে সে । আনন্দে জীবন কাটিয়ে দেবে ।

মামাবাবু ঘুমোচ্ছেন অকাতরে । হাইপার টেনশনের রুগি । অসুধ খেয়ে ঘুমোতে হয় । অনন্যার চোখে ঘুম নেই । পায়ের ঘুঙ্গুরের আওয়াজের সাথে ভেসে উঠছে অনীকের মুখ । " আচ্ছা , অনীক নিশ্চই বিয়ে করে সুখে আছে ? প্রশ্ন জাগে ওর মনে ।

অন্য দিকে অনীকের জীবন বয়ে চলেছে আর এক খাতে । ফার্স্ট ইয়ার থেকে ইউনিয়ন করা অনীক এখন লোকাল  এম এল এ , পলিটিকাল লিডার , ৪২ বছর বয়স । রাজনীতি চর্চাতেই মন দিয়েছে সে । অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে  বলে চাকরি করার চাপ ছিল না তার । অনীকের এখন খুব নাম ডাক । মিটিং মিছিল , জনস্রোত লেগেই আছে তার জীবনে । নাহ , অনীক ও বিয়ে করে নি । সমাজ সেবা তেই দিব্যি কেটে যাচ্ছে দিন । প্রতিদিনের কর্ম ব্যাস্ততার মাঝেও কলেজ জীবন কে ভোলেনি সে । ভোলেনি অনন্যার কথা । অনন্যাদের টেলিফোন ছিলও না , তাই আর যোগাযোগ রাখা হয়ে ওঠে নি ।

হঠাৎ ই দীঘা বেড়াতে যাবার সুযোগ আসে । সমাজ সংস্কার মুলক কিছু কাজের তাগিদে । সঙ্গে বেশ কিছু সংগী সাথীও রয়েছে । দীঘায় সাত দিন হোল এসেছে সে । কাজকর্ম শেষ করে দুদিন হোল সমুদ্রে স্নান করেছে সে । পরের দিনই কলকাতা ফেরার কথা । সন্ধ্যেবেলা সি বিচে হাঁটতে বেরোলো অনীক । সঙ্গে আজ আর লোকজন নেই । একটু একা সময় কাটাতে চাইছে মন ।

হাঁটতে হাঁটতে অনীক হঠাৎ দেখতে পায় বহু দুর থেকে দুজন মানুষ এদিকেই হেঁটে আসছে । একটু ভালো করে দেখে সে । বছর ৪০ এর একজন মহিলা ও এক বুড়ো ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন । অনীক একটু এগোতেই চিনতে পারে অনন্যা কে ।থমকে যায় সে । অনন্যা ও কাছে এসে থমকে গেছে । আরে অনীক না ? হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে দুজন দুজনের দিকে ! কি কথা  বলবে ওরা ?

 অনন্যা স্ক্র্যাচে ভর করে এগিয়ে আসে-" তুমি অনীক না "? অনন্যার চোখ ভরা বিস্ময় ! অনীক বলে ওঠে - " হ্যাঁ , আমি অনীক , তোমার এই অবস্থা হোল কি করে "?

আর কিছু বলতে না পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে অনন্যা । অনীক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে । মামা বাবুও এগিয়ে এসেছেন । অনন্যা বলে - " তুমি একা এসেছ না স্ত্রী সঙ্গে আছেন "? অনীক তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে - " আমি বিয়ে করিনি অনন্যা , আমার হবু স্ত্রী আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছেন অনেকদিন আগেই ।"

অনন্যা -" আমি যদি পারতাম তাহলে তাকে খুঁজে এনে দিতাম তোমার কাছে ।"-বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ।মামাবাবু পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অনীক কে বলেন -" অনীক , অনন্যা অনেক বছর তোমার অপেক্ষায় ছিল । কিন্তু খোঁজ পায়নি কোন । ৩০ বছর বয়সে একটা  পা বাদ যায় ওর । নাচও বন্ধ হয়ে যায় "।

লজ্জায় ও  হতাশায় মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে অনন্যা । অনীক বলে -" আমি কাল কলকাতা ফিরবো অনন্যা ।"

অনন্যা -" আমরাও , মামাবাবু বললেন অনেক দিন একঘেয়ে জীবন কাটছে , তাই ঘুরতে এলাম কদিনের জন্য । "

এরপর অনীক ওদের জানায় নিজের কর্মকাণ্ডের কথা , লোকাল এম এল এ হয়ে ওঠার কাহিনি ।

মামাবাবু বলেন -" এত কিছুর মধ্যেও অনন্যা কে মনে রেখেছ ? তোমার হবু স্ত্রী , সে হারিয়ে গেলো কি করে ? বিয়ে করোনি তাহলে ?" এটুকু কথা বলার পরেই অনন্যা মামার হাত ধরে টান দেয় -" চলো মামা , হোটেলে ফিরে যাই , অনীক , আশা করি তোমার হবু স্ত্রী কে খুঁজে পাবে তুমি কোনদিন, ভালো থেকো । " বলে স্ক্র্যাচ নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে সে ।

অনীক বলে- " দাঁড়াও অনন্যা , আমার হবু স্ত্রীর ছবি দেখবে না ?" বলে পকেট থেকে একটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ফটো বার করে অনন্যার হাতে দেয় অনীক । অনন্যা দেখে চমকে ওঠে ! এ যে তারই কলেজ সোশাল এ পারফরমেন্সের ফটো । এ কি দেখছে সে ? 

অনীক বলে - " আর নয় অনন্যা , আজ থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমার । তোমাকে আমি জয়পুর ফুট পরাবো । আবার নাচবে তুমি , সুধাচন্দন যদি পারে , তাহলে তুমি কেনও নয় ? আমি সব ব্যাবস্থা করব,কাল আমরা কলকাতা যাচ্ছি ,ব্যাস !"

আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠে অনন্যা । হাত দিয়ে মুখ ঢাকে ।তাহলে তার স্বপ্ন এই জন্মেই পূরণ হবে ? মামাবাবু এগিয়ে এসে অনন্যা মাথায় হাত রাখেন । অনীক তার চোখের জল মুছিয়ে দেয় । দু হাত দিয়ে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করে অনন্যা ! কিন্তু পারে না ।



Comments

Popular posts from this blog

ONCE IN A SUNNY MORNING(Poem)

A Memorable Marriage

DEATH OF BHOKU- My Pet Parrot