টাকা যখন ফা৺কা (রম্যরচনা)


 কর্তা - " বলি ও গিন্নী , পারলে নাকি গুনে শেষ করতে ?"
গিন্নী-" না গো , তুমি ঘুমিয়ে পড়ো , আমি গুনি , রাত কেটে যাবে গো !"
কর্তা - " না গো , এ ভূত তেমন ভূত নয় , নেহাত মন্দ দেয়নি টাকা ।"
গিন্নী - " ভূত টা বেজায় ভালো ,
হথাত দেখা দিল,
চাইলাম শুধু টাকা ,
আলমারি যে ফাঁকা !"
কর্তা - " বাবা , এই মাঝরাতে হথাত পদ্য আওড়াচ্ছ যে ? "
গিন্নী - টাকা পেয়ে মন আনন্দে নাচে,
খেয়ে পড়ে সুখে ছেলে মেয়ে বাঁচে ।"
কর্তা - " বেশ বেশ , তুমি পদ্য আওড়াও , আর টাকা গোন , আমি বরং আরেকটু ঘুমিয়ে নি , একটু পরেই সকাল হবে ।"
গিন্নী - " দাঁড়াও তো , খালি ঘুম আর ঘুম , আরও কতো বান্ডিল আছে । খোলা হয়নি , টাকা গুনতে কতও মজা ।"
কর্তা দিব্যি ঘুমোলেন নাক ডাকিয়ে ।

এমন সময় সেই টাকার ভূত টা আবার দেখা দিলো -
ভূত -" বলি আরও চাই নাকি ? লাগলেই পাবে , তোমাদের আর চিন্তা কি ? আমার ঘাড়েই যত দায়িত্ব ।"
গিন্নী - " বল কি ? আরও টাকা দেবে ! আদজন্মে কি পুন্যি করেছিলাম কে জানে , জয় মা ।"
ভূত - " আরে এ টাকা তোমার পুন্যের টাকা নয় । এ হোল আমার পাপের কালো টাকা । টাকা কামাতে কামাতে মরে গেলাম - যমরাজের দরবারে যেতেই হুকুম হোল - ব্ল্যাক মানি হোয়াইট করতে হবে , তাই ভাবলাম কয়েকটা গরীব পরিবারে টাকা গুলো বিলিয়ে দিই ।"

কর্তা ঘুমোচ্ছেন নাক ডাকিয়ে - গিন্নী -" কর্তা ঘুমো লো , পাড়া জুড়লও  , দাও দেখি আর কতো দিতে পারো ।"
ভূত - "এই নাও আরেকটা দু হাজার টাকার নোটের বান্ডিল দিলাম ,আর চেও না যেনও , এবার একটু অন্য পরিবার গুলো কে দেখি ।"
গিন্নী- " অ , তা ভালো , মরার পরে পুন্যি করছ । মরার পরে দান সাগর ।"
ভূত - বেঁচে থাকতে শুধুই পাপ করেছি , তাই এখন পুন্যি করতে হচ্ছে !"
বলে ভূত বাবাজী উধাও হোল ।

এমন করেই কয়েকটা পরিবারে  টাকা দিয়ে , সে তার ব্ল্যাক মানি হোয়াইট করলো , পাপের ভার ও কিছু কমলো ।
ভূত ফিরল যমরাজের দরবারে - " আজ্ঞে রাজা মশাই , আপনার কথা মতই কাজ করেছি , এবার আমায় দয়া করে সগগে পাঠাবার ব্যাবস্থা করুন ।"
যমরাজ -" তা বেশ , এবার তুমি মুক্ত , শুধু স্বর্গে কেনও , তুমি এ লোক সে লোক ঘুরে দেখতে পারো । একটু ঘুরে ফিরে বেড়াও এখন , যত দিন না পুনর্জন্মের আদেশ হচ্ছে ।"


ভূত অনুমতি সহ তার যাত্রা শুরু করলো , কিন্তু মুশকিল হোল , যে লোকেই সে পা রাখছে , দেখছে সেখানে সকল দেবতা , গন্ধর্ব , ও আত্মাগন শুধুই টাকা গুনছে ।
ভূত এ তো মহা সমস্যা দেখছি , কেউ মুখ তুলে চায়না , কথা বলে না , গান করে না , নৃত্য করেনা , চারিদিকে শুধু টাকা , আর যেনও ভালো লাগছে না ।"

ভূত এবার এ লোক সে লোক ঘুরে যম লোকেই ফিরে এলো ।
যমরাজ - " এ কি শুনছি , চিত্রগুপ্ত , সব লোকেই সবাই কেবল টাকা গুনছে !"
চিত্রগুপ্ত - " আজ্ঞে রাজামশাই ,  অর্বাচীনের দল পৃথিবী থেকে যতও পেরেছে কালো টাকা এনে জড় করেছে , তাই গুনে এখনো শেষ করতে পারে নি ।"
ভূত - " আজ্ঞে ,ভদ্র মহদয় গন , যদি দোষ  না নেন , একটা কথা বলি , পৃথিবী তে এক রকম টাকা গোনার যন্ত্র পাওয়া , তাড়াতাড়ি গোনা শেষ  হয়ে যাবে ।  যদি জোগাড় করতে পারেন ।"
যমরাজ - " তাহলে যাও , আবার পৃথিবীতে জন্ম নাও , এবারে জীবন্ত চলে এসো । সেই যন্ত্রটা নিয়ে এসো ।আমার যমদূতেরা তোমার সঙ্গ ছাড়বে না , ,আর আসার সময় আরও কিছু টাকা আনতে ভুলো না ।"

বিচিত্রগুপ্ত - রাজামশাই দেখছি ভুল্ভাল বকছেন । এই আত্মা টি  পৃথিবী তে জন্ম নেবে , বড় হবে , তারপর টাকা গোনার যন্ত্র নিয়ে ফিরবে , এ তো প্রচুর ঝামেলার ব্যাপার ।"
চিত্রগুপ্ত - হ্যাঁ রাজামশাই , টাকার চিন্তায় আপনার ও দেখি মাথা খারাপ হোল ।"

তারচেয়ে বরং আমি এখনি যাই , যন্ত্রটা নিয়ে আসি , কিন্তু আনবই বা কি করে , হাত পা যে হাওয়া !"
যমরাজ - " সত্যিই তো , এসব কথা বিবেচনা করে দেখা উচিত , এমন তো হতে দেওয়া যায় না । স্বর্গ লোক , গন্ধর্ব লোক , শিব লোক , বিষ্ণু লোক , ব্রহ্ম লোক সব জায়গাতেই একি অবস্থা !"
চিত্রগুপ্ত - " পৃথিবীতে দেখছি টাকার পরিমান বেড়েই চলেছে , তাও কত লোক না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে । হিসেব যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে !"

ভুত- " আজ্ঞে , এখন তবে আমার কি কাজ ?"
যমরাজ- " শোনো বৎস , তোমাকে এখন পৃথিবী তে যেতে দেবো না , তুমি বরং দুজন যমদূত কে সঙ্গে নিয়ে একবার পাতাল লোকটা ঘুরে দেখে এসো । ওখানকার খবর এনে দাও । দেখছ না চিত্রগুপ্ত বিচিত্রগুপ্তের হিসেব সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ।একটু সাহায্য করো বাবা ।"
ভূত - " বেশ তবে তাই হোক ,।"

দু জন যমদূত কে সঙ্গে নিয়ে ভূত উড়ল পাতালের উদ্দেশ্যে , অবশেষে পাতালে পৌঁছে  ভূত দ্যাখে , এ কি কাণ্ড ? টাকার হাওয়া যে এখানেও লেগেছে , পাতালের যতও নাগ নাগিনী ,যক্ষ যক্ষী গন টাকা গুনছে । হায় হায় -
ভূত একজন যক্ষ কে জিজ্ঞাসা করে ," হ্যাঁ গো ভাইয়েরা তোমরাও কি পৃথিবী থেকে টাকা পেয়েছ ?"
যক্ষ -" তাছাড়া আবার কি , টাকা গুলো উড়ে যাচ্ছিলো সব স্বর্গের দিকে , অনেক কষ্টে কিছু বাঁচিয়েছি !"
ভূত -" কিন্তু টাকা তোমাদের কি কাজে লাগবে ?"
যক্ষ - " তা তো জানিনা , কিন্তু টাকা গুনতে খুব মজা , জমাতে ভারী নেশা হয় , তাই ভালো লাগছে !"
ভূত - " আচ্ছা ভাই , তোমরা কি মেশিন মানে যন্তর দিয়ে টাকা গুনছ ?"
যক্ষ - " হ্যাঁ গো , তেমন যন্তর একটা আছে তো , কাছেই পৃথিবীর যে জায়গাটা সেখানে পেলাম , তোমাদের সেই পুলিশ নাকি কারা আছে সে তো দিলো দয়া করে ! তাই নিয়ে এলুম কদিন আগে , নইলে আমাদের ক্ষমতা কি টাকা গুনে শেষ করার !"
ভূত - " তেমন যন্তর আমাদের একটা দিতে পারো ?"
যক্ষ - " নাহ গো , আর যে নেই , এই একটা দিয়েই কাজ চালাচ্ছি ।"


ভূত তখন আর কি করে ? আবার সে যমরাজের দরবারে ফিরে এলো ।


ভূত - "আজ্ঞে রাজামশাই , পাতাল লোকের একই দশা , তারাও শুধু টাকাই গুনছে , মন্দের ভালো ওরা একটা যন্তর জোগাড় করেছে অনেক কষ্টে ।"
যমরাজ - "এ বড় দুর্দিন , বৎস , আমি তোমাকে এখন ই পুনর্জন্মের আদেশ দিতে পারছি না , পৃথিবী তে গেলে তুমি টাকার চক্করে আবার পড়বে , প্রারব্ধ আর কাটবে না । "
চিত্রগুপ্ত হঠাৎ বলে ওঠেন -" রাজা মশাই হিসাব মত বৎসের মৃত্যুর কারন টাকা , তাই টাকার খেলা শেষ হলে  ওকে তবেই পুনর্জন্ম দেওয়া যাবে । পরের জন্মে বাছা আর কালো টাকার পিছনে দৌড়ীও না , সাদা টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকো ।"
বিচিত্রগুপ্ত - " বর্তমানে তোমাকে গন্ধর্ব লোকে পাঠাচ্ছি , সঙ্গে কেউ যাবে না, তুমি একাই উড়ে যাও । দেখো ওদের একটু বুঝিয়ে যদি সংগীত কাব্য চর্চায় আবার মন দেয় সবাই । না হলে পরিবেশ যে কলুষিত হয়ে যাবে !"

ভূত গেলো গন্ধর্ব লোকে -" টাকা কি জিনিস মরার পরে বুঝছি , মরার আগে ভাবতাম টাকাই সব , এখন দেখছি এর অনেক খারাপ দিকও রয়েছে ।"

গন্ধর্ব লোকের বাসিন্দাদের ভূত যমরাজের কথা মতো সব বুঝিয়ে বললে । তারা তা শুনেও শুনলে না ! -"অনেক যুগ তো শিল্পচর্চা করে কাটালাম , কিন্তু টাকা বড় আমোদের জিনিস , এর মায়া ছাড়া যাবে না । তুমি বোলো গিয়ে যমরাজ কে ।"

এরপর শিব লোক বিষ্ণু লোক ও ব্রহ্ম লোকের ও যথাক্রমে একই হাল হোল ।

ভূত বিফল হয়ে ফিরল যমরাজের সভায় - 
যমরাজ - " জানি না বৎস , অন্যদের কি হাল হবে , তবে তুমি মৃত্যুর পর যে কর্তব্য পালন করলে তাতে তোমার পাপের ভার লঘু হয়েছে , এখন তুমি সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে পুনর্জন্ম পাবে ।"

তাদের চলতি কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ ই স্বয়ং শ্রী বিষ্ণুদেব আবির্ভূত হলেন যম লোকে -----

সকলে হে জনার্দন বলে পায়ে পড়লে , বিষ্ণু স্বয়ং বললেন -" হে যমরাজ , তোমার বিচার ভুল নয় , কিন্তু শুধু এই বৎস টির মুক্তির কথা ভাবলে তো চলবে না , টাকা যখন ওকে এখানে টেনে এনেছে তখন পুরনো পরিবেশেই ওকে আবার জন্ম নিতে হবে , আরও অনেক দীনদরিদ্রের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে,আরও অনেক মানুষের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে হবে, তারপর আমি বিষ্ণু লোকে ওর স্থান করে দেবো ।"
"অর্থই অনর্থের মূল বটে , তাই তা উপলব্ধি করার জন্যই আমি সৃষ্টি তে গোলযোগ বাধিয়েছি , কলি যুগের শেষে যখন প্রলয় আসবে তখন সব টাকার সলিল সমাধি ঘটবে , টাকা মাটিতে পরিণত হবে । সত্য যুগ এলে পৃথিবী তে সোনার ফসল ফলবে । দূর হবে সব কষ্ট ,-- এ আমারই লীলা ,সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা এখন ঘুমন্ত , ভগবান শিবশঙ্কর ধ্যানমগ্ন ,তাই দেখা দিয়েছে সমস্যা ,কিন্তু এখন ও অনেক সময় বাকি , নতুন সৃষ্টি হওয়ার আগে অবধি আমি বৎস কে পৃথিবীতেই পুনর্জন্মের নির্দেশ দিচ্ছি , এই তো লীলা মাহাত্ম্য !"


সকলে স্তব্ধ হয়ে এতক্ষন শ্রী বিষ্ণুর কথন শ্রবন করছিলেন । এইবার ভূত পুনর্জন্ম নিতে পৃথিবী তে গেলো , আর চারিদিকে রব উঠলো ------" সাধু সাধু সাধু "।




Comments

Popular posts from this blog

ONCE IN A SUNNY MORNING(Poem)

DEATH OF BHOKU- My Pet Parrot

A Memorable Marriage