আজকের বৃহন্নলা(সামাজিক গল্প)
অজয় - নাম টা খুব সাধারন । ছোট্ট একটা কোম্পানি তে সাধারন চাকুরে সে । জীবন টা সাধারন ভাবেই কেটে যাচ্ছিলো । বাড়িতে তেমন লোকজন নেই । মা , স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়ে কে নিয়ে সংসার , সুখেই কাটছিল তাদের । হঠাৎ একটা ঘটনা সবকিছু ওলটপালট করে দিলো ।
অজয়ের বাবা একটা লোহার কারখানায় কাজ করতেন । বেশি টাকা পয়সা জমাতে পারেন নি । অজয়ের অল্প মাইনের কাজে সংসারে খুবই টানাটানি করে চলে । তবুও চালিয়ে নিচ্ছিল তারা । অভাব থাকলেও শান্তির সংসার । মাত্র এক বছর আগে মেয়ের জন্ম । সুখেই কাটছিল দিন । কিন্তু করোনা আব্হাওয়ায় লক ডাউন শুরু হোল । কোম্পানি বন্ধ হোল অনির্দিষ্ট কালের জন্য । অজয়ের চাকরি চলে গেলো ।
অজয়ের মাথায় যেন বাজ পড়লো । কি করে বাড়িতে গিয়ে এই খবর দেবে সে ? বাসে উঠে মুখ ভার করে বসে রইলো সে । বাস চলতে শুরু করলো । চোখের সামনে স্ত্রী , কন্যা ও মায়ের অসহায় মুখ ভেসে উঠছে । তার ওপরেই নির্ভর করে সকলে ।
হঠাৎ ই জোরে জোরে তালি আর মোটা গলায় গানের আওয়াজে অজয়ের ঘোর ভাঙলও । সে দ্যাখে বাসে একদল বৃহন্নলা নানান অঙ্গভংগী করে পয়সা নিচ্ছে সবার কাছ থেকে । এটাই তাদের জীবন ধারনের পদ্ধতি । অজয়ের মাথায় হথাত একটা বুদ্ধি খেলে যায় ! অজয় , অজয় ও তো পারে এইভাবে টাকা উপার্জন করতে । শুধু মেয়ে সেজে একটু গানের তালিম নিতে হবে , তাহলে হয়তো বাড়ির মানুষ গুলোর মুখে অন্ন তুলে দিতে পারবে সে !
অজয় তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয় । এই পথেই সে তার অভাব মেটাবে । একে তো লকডাউনের জেরে ভবিষ্যৎ প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে । নাহ , আর অপেক্ষা নয় । অজয় ওদের সাথেই বাস থেকে অজানা একটা স্টপেজে নেমে পড়ে । ওদের সাথে আলাপ করে , হাতে অল্প কিছু টাকা দেয় সে । ওরা খুশি হয় ।
রাস্তায় দাঁড়িয়েই নিজের সমস্যার কথা ওদের জানায় অজয় । এই জীবিকায় আসার জন্য কি করতে হবে সবকিছু নিখুঁত করে জানতে চায় সে । সে জানায় পুরুষ হয়েও এই পেশায় আসতে চায় সে । উত্তরে ওরা জানায় -নকল বৃহন্নলা সাজার উপায় রয়েছে । এটিও উপার্জনের একটি পথ । এতে কোন অসাধুতার জায়গা নেই । অসাধু ব্যাবসায়ী রা কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুটছে । এতও সামান্য মহিলা সেজে মানুষের মনোরঞ্জনের কাজ ।
সব শুনে খুশি মনে বাড়ি ফিরল অজয় । স্ত্রী ও মা কে পরে সব জানাবে সে । তাদের ও যে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে । এইভাবেই কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে ওদের ডেরায় গিয়ে কাজ শেখা শুরু করলো অজয় । দিন কয়েক তালিম চললো - কাজ টিতে বেশ সাহসিকতার প্রয়োজন রয়েছে । শাড়ি পরা , চুল বাধা, গয়না পরা , মেক আপ করা থেকে শুরু করে কয়েকটা জনপ্রিয় গানের কলিও শিখতে হোল ।প্রথমে একটু লজ্জা পায় অজয় । তারপর জীবনের তাগিদে সব কুণ্ঠা সরিয়ে ফেলে কাজ শুরু করে সে ।
রোজগার পাতি হতে থাকে মোটামুটি । কিন্তু স্ত্রী ও মা কে জানাতে হবে এবার সবকিছু ।তার চাকরি বন্ধ । বেকার হয়ে কাপুরুষের মতো জীবন কাটানোর থেকে , এ অনেক ভালো । কিন্তু মা আর বউ মেনে নিতে পারবে তো ? পারতে তো হবেই , বাস্তব টা যে বড়ই কঠিন ।
সুযোগ বুঝে একদিন পোশাক না বদলেই বাড়ি ফেরে সে । নাহ, পাড়ার কেউ এখনও দেখেনি । বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে অজয় । স্ত্রী দরজা খুলে দেখে এক মহিলা দাঁড়িয়ে । স্ত্রী বলে ওঠেন -" আপনি এখানে কেনও ? আমার তো একবছর আগেই বাচ্ছা হয়েছে, তখন তো মাসি রা টাকা নিয়েই গেছেন ।"
অজয় হেসে ফেলে ঘরে ঢোকে । সব কথা খুলে বলে স্ত্রী কে । কিছুদিনের মধ্যে হয়তো বাস ট্রাম চলাও বন্ধ হয়ে যাবে !তখন তো রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেই হবে অজয় কে ।লোকজন জানলে ঘৃণা করলে করুক । তবু তো সে বাঁচবে , তার পরিবার বাঁচবে !
স্ত্রী তার প্রচেষ্টা কে স্বাগত জানায় । এবার মাএর পালা । কিছুদিন এভাবে সংসার চালানোর পর একদিন মাকেও সব খুলে বলে অজয় ।মা বুঝতে পারেন ছেলের অবস্থা , কাজেই আর কোন সমস্যা রইলো না ।
এভাবেই নিশ্চিন্তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো সে । পাড়ার বেশকিছু লোক নানা কুমন্তব্য ছুঁড়ে দেয় তার দিকে । কিন্তু অজয় এড়িয়ে চলে সব কিছু ।
অজয় কিন্তু ক্রমশ উন্নতি করতে থাকে তার কাজে । এভাবেই চলে যাচ্ছিলো দিন । কিন্তু একদিন রাস্তায় এক ফিল্ম ডিরেক্টরের চোখে পড়ে অজয়ের চেহারা আর অভিনয় । তিনি বলেন -" এভাবে রাস্তায় ঘুরে কাজ না করে আমার ফিল্মে কাজ করুন না ! আরও বেশী উপার্জন হবে আপনার ! আমার কার্ড রাখুন, যোগাযোগ করবেন কিন্তু ।"
এই ঘটনা মা ও স্ত্রী কে জানায় সে । মা বলেন -" যেটুকু পাচ্ছিস তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক না রে , " কিন্তু স্ত্রী ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী , তিনি অজয় কে ফিল্ম ডিরেক্টরের প্রস্তাব মেনে নিতে বলেন । অজয় দেখা করে সেই ব্যাক্তির সাথে ।
ভদ্রলোক কথা না বাড়িয়ে অজয় কে সরাসরি শুটিঙে আসার প্রস্তাব দেন । বলেন -" স্ক্রিপ্ট শোনানো হবে অন স্পট ,সেখানেই অভিনয় করতে হবে । তারপর পেমেন্টের ব্যাপার । " অজয় স্ত্রীর উৎসাহে , মা এর কথা অমান্য করে রাজী হয়ে যায় !
শুটিং করতে গিয়ে অজয় বুঝতে পারে যে তাকে ডামী বানানো হয়েছে । সে ডিরেক্টর কে জিজ্ঞাসা করে এই কথা । ডিরেক্টর জানায় এভাবেই কাজ করতে হবে । কিছু টাকাও দেন হাতে ।
লোভ বেড়ে যায় অজয়ের । এভাবেই দিন তিনেক শুটিং চলে , অজয় নাছোড় বান্দা , এর শেষ দেখে তবেই ছাড়বে সে । কিন্তু বৃহন্নলা সেজে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ ই উঁচু একটা জায়গা থেকে পড়ে গিয়ে প্রান হারায় সে ।মুখ থুবড়ে পরে , মৃত্যু হবার মুখে সে শুনতে পায় তার মাএর গলার আওয়াজ -" বাছা , তোর লাগেনি তো ?"
ওদিকে অজয়ের মা ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেন- কি খারাপ স্বপ্ন ! ছেলের মৃত্যু !, না না ভগবান আছেন ! ভয় নেই , সব ঠিক হবে !তবুও মা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠেন " বাছা , তোর লাগেনি তো । বিছানায় স্ত্রী ও কন্যা ঘুমিয়ে কাদা । মা অস্থির হয়ে উঠে বসেন ।
পরদিন ভোরের আলো ফুটতে ই অজয়ের নিথর দেহ টা বাড়ি তে নিয়ে আসে কিছু লোকজন । সব শেষ । মা ডুকরে কেঁদে ওঠেন । হতভম্ব স্ত্রী কোন ভাষা খুঁজে পায়না কথা বলার ।
Comments
Post a Comment