পিকনিকে গণ্ডগোল (ভৌতিক কাহিনী)
একটা সুন্দর দেখতে শাড়ী পরেছে নীলা । কলেজ থেকে পিকনিকে যাবে সে । বন্ধুদের সাথে । বাড়ির থেকে বেরনোর সময় মা কে বলে আসা হল না । মা এর অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরী হয় । নীলা বিকাল বেলা বাড়ির থেকে বেড়িয়েছে । বাবা , ঠাকুমা সবাইকে বলেছে । বারুইপুরের রাজ বাড়ি তে তারা বন্ধু রা মিলে এক রাত কাটাবে । পরের দিন সকালে আবার ফিরে আসবে । মা কে বলা হল না বলে নীলার মন টা খচখচ করছিলো ।
যাই হোক , মা এর দেওয়া সুন্দর শাড়ী টা পরে কলেজ চত্বরে এলো সে । আজ সকালে তারা ক্লাস অফ করেছে । সন্ধ্যে বেলা পিকনিকে যাবে । তাই এতো তোড়জোড় করা হয়েছে সারাদিন । ওরা দশজন পিকনিকে যাচ্ছে । ক্লাসের বাকি মেয়ে রা যেতে রাজি হয়নি , রাতের পিকনিকে ।
দশ বন্ধু একে একে জড়ো হোল । পিকনিকের বাস ও এসে গেছে । তখন বিকেল ৫ টা । নীলা ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠলো । অস্মিতা , টগর , রিমি , এবং অন্যান্য রাও বাসে উঠে বসে আছে । শুকনো খাবার , মাংস ভাতের আয়োজন সম্পূর্ণ তৈরি । একবার বারুইপুর যেতে পারলেই জমিয়ে রান্না বান্না করে খাবে সকলে ।
বাস ছাড়ল বিকাল ৫ টা । বারুইপুর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হোল ওরা । বাস চলছে জোরে । ওরা বন্ধুরা মিলে গান ধরল । এক সাথে গান গাইতে গাইতে পিকনিকে যাবার মজাই আলাদা ।
এবার আসা যাক বারুইপুর রাজবাড়ির কথায় । বারুইপুরে বিখ্যাত এই রাজবাড়ি । শোনা যায় ইংরেজ আমলে এ অঞ্চলের রাজা রাজেন্দ্র বর্মণ ছিলেন প্রভূত সম্পত্তির মালিক । তারপর ইংরেজ দের সাথে লড়াই এ হেরে যান এবং সকল সম্পত্তি বন্ধক দেন । তারপর অসুস্থ হয়ে পড়ে মারা যান । রাজেন্দ্র বর্মণের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীর ও মৃত্যু হয় । তাদের পুত্রকন্যা রা সকলেই বিবাহিত । এভাবেই সমাপ্তি ঘটে তাঁর সুখের সংসারের । তাদের প্রিয় বাড়ি আজ ও পড়ে আছে অযত্ন অবহেলায় ।চারিদিকে আগাছা জঙ্গল ভর্তি । মাঝে মাঝে ট্যুরিস্ট আসে , তাই আশপাশের লোকেরা পথ বলে দেয় তাদের । কথিত আছে , মাঝে মাঝে যারা বেড়াতে আসে তারা দিনের বেলাই পিকনিক করে ফিরে যায় । রাতে এ তল্লাটে কেউ থাকে না ।
নীলা দের গাড়ি রাজবাড়ির কাছে এসে পৌঁছায় সন্ধ্যে ৭ টা । ওরা মেয়ে রা গাড়ি থেকে একে একে সব জিনিস নামাল । ড্রাইভার দাদা ওদের সাহায্য করলো খুব । সে একেবারে রাজবাড়ি অবধি সব জিনিস পৌঁছে দিলো । পরের দিন দুপুরে ড্রাইভার দাদা আবার আসবে ওদের নিতে। এই ঠিক হোল ।
নীলা রা দশ জনে পুরনো রাজবাড়ি তে ঢুকল ।দরোয়ান গোছের একটা লোক এসে ওদের দরজা খুলে দিলো । বিশাল বড় এই রাজবাড়ি । অনেক ঘর তালাবন্ধ পরে আছে । ধুলো ময়লায় ভর্তি সারা বাড়ি । নীলা রা বন্ধু রা মিলে , নিচের হলঘর টা ঝাঁট দিলো । তারপর রান্না বান্না চাপিয়ে দিলো । রান্না করতে করতে ওরা সবাই গল্প করছিলো । রান্না শেষ হোল রাত ১০ টা । ওরা ঠিক করেছে , ওপরে উঠবে না আজ । হলঘরেই খেতে খেতে গল্প করছে ওরা ।এখানেই রাত কাটিয়ে দেবে । পরের দিন পুরো রাজবাড়ি টা ঘুরে দেখবে একসাথে । তারপর দুপুরে বাস এসে গেলে কলকাতার দিকে রওনা হবে ।
শীতের রাত্রি । ওরা খাওয়া দাওয়া সেরে নিলো । তারপর বাসন পত্র গুছিয়ে রেখে , লম্বা বিছানা পাতলো হল ঘরে । নীলা , টগর , অস্মিতা , রিমি , শীনা , দেবী , মালতী , জবা , মিলি , সুচিত্রা -এই দশজন মিলে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে । রাত বাড়ছে , ঠাণ্ডায় সবাই আরামে ঘুমিয়ে পড়লো গল্প করতে করতে ।
রাত তখন ২ টো । সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । এমন সময় নীলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো । একটু বাথরুম যাওয়ার দরকার । ঘরের ধারের দিকেই একটা বাথরুম আছে । নীলা উঠতে যাবে এই সময় ছুম ছুম করে নুপুরের আওয়াজ । নীলা চমকে উঠলো । এত রাত্রে কে নাচ করছে ?আওয়াজ টা আসছে ওপরের কোন ঘর থেকে ! নীলা বুঝতে পারে না কি করবে ? সবাই কে ডেকে তুলবে ? না থাক - ওদের সকলের মধ্যে টগর বেশ সাহসী আছে । সে নীলার পাশেই শুয়েছে । নীলা আস্তে করে বলে -" টগর , এই টগর , শুনতে পাচ্ছিস ? একটু ওঠ না ! আমি বাথরুমে যাবো , চল না , আমার সঙ্গে !"
টগর ঘুম ভেঙ্গে উঠে বলে-" হ্যাঁ চল , আমি যাচ্ছি তোর সঙ্গে ।" নীলা মুখে আঙ্গুল দিয়ে ওকে চুপ করতে বলে । তারপর ঈশারায় ওপরে , মানে দোতলার দিকে আঙ্গুল দেখায় । নুপুরের ছুম ছুম শব্দ টা তখন ও হয়ে চলেছে । নীলা আর টগর দুজনেই একটু ভয় পেয়েছে ! মাঝরাতে ছুম ছুম নুপুরের শব্দ , গা ছম ছম করা একটা অনুভূতি । ওরা ঠিক করলো আস্তে আস্তে উঠে বাথরুম সেরে আবার শুয়ে পড়বে । দুজনে পা টিপে টিপে বাথরুমে গেলো । বাথরুম সেরে চোখে মুখে জল দিলো । তারপর বেরিয়ে এসে শুতে যাবে তখন শুনতে পেলো একটা বিশ্রী হাসির শব্দ । কে যেন কাকে চাবুক দিয়ে মারছে । আর একটি মেয়ে যেন করুণ সুরে গান গেয়ে চলেছে । সমস্ত আওয়াজ টাই আসছে ওপরের দিক থেকে ।
টগর বলে - " আচ্ছা নীলা , ওপরে গিয়ে দেখলে হয় না ? কি ব্যাপার টা ? এত রাতে কারা ?" টগরের কথা শেষ করতে দেয় না নীলা । সে বলে - " চুপ , একদম চুপ , শুয়ে পড় । এতো রাতে রাজবাড়িতে এসব হয়েই থাকে । এসব নিয়ে আর কোন ও কথা নয় । বেশি সাহস তোর ! ওপরে গেলে আর প্রান নিয়ে ফিরতে হবে না !" এই বলে সে টগরের হাত ধরে টেনে বিছানায় শুয়ে দেয় । রাত তখন ৩ টে । থম্থম করছে সারা বাড়ি । ঘুঙ্গুরের আওয়াজ , কান্না , হাসি আর গান ,সব মিলিয়ে অদ্ভুত দম বন্ধ করা পরিস্থিতি ! সবাই ঘুমলেও টগর আর নীলা ঘুমোতে পারে না । তারা সকালের অপেক্ষায় রয়েছে !তাড়াতাড়ি এ অভিশপ্ত রাজবাড়ি ফেলে বাড়ি অর্থাৎ কলকাতায় ফিরতে চায় তারা ।
এমন সময় -
উপরের সিঁড়ি দিয়ে ঘুঙ্গুরের আওয়াজ টা ক্রমশ নিচের দিকে নামে ! টগর আর নীলা ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছে । চোখ পিটপিট করে তারা দ্যাখে এক মেয়ে -অপূর্ব সুন্দরী , ছায়ার মতো নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে ! সঙ্গে সেই গান আর ঘুঙ্গুরের আওয়াজ ।
মেয়ে টি এসে হলঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো ! ওরা বন্ধুরা যেখানে শুয়েছে তার থেকে একটু দুরে । ভয়ে হাড় হিম হয়ে এলো টগর আর নীলার - এ তো মানুষ নয় কোন মতেই । আর সেই বিশ্রী হাসি আর ও জোরে শোনালো - " চলে এসো , আমাদের কাছে এসো , ওপরে চলে এসো , ভয় কি ?" কে যেন চাপা গলায় বলে উঠলো !
টগর আর নীলা কোন রকমে ঘুমের ভান ধরে রয়েছে । চোখ খুলতেই ওদের ভয় করছে প্রচণ্ড !
পরের দিন -
ভোর ৬ টায় কাক ডাকার আওয়াজে ঘুম ভাঙল সবার। সবাই দেখে টগর আর নীলা তখন ও ঘুমোচ্ছে । অস্মিতা ওদের ডেকে দিলো । ধড়মড় করে উঠে বসলো দুজনে । চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি ! অস্মিতা হেসে বলে -" কি রে স্বপ্ন দেখছিলি নাকি ? সকাল হয়ে গেছে , তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে নে । ঘুরে দেখতে হবে পুরো রাজবাড়ি টা ।তারপর ড্রাইভার দাদা এসে যাবে । ফিরতে হবে ।"
সবার জলখাবার খাওয়া শেষ , এবার নীলা বলে -" রাজবাড়ি আর কি ঘুরে দেখবো , তার চেয়ে চল এই বাগান টা ঘুরে দেখি ।" বলে সে টগর কে ঈশারা করে , টগর ও এক ই কথা বলে । ওরা আসলে চাইছে না ওপরে যেতে - কাল রাতের যা অভিজ্ঞতা !
অস্মিতা বলে - " না না , আমার খুব রাজবাড়ি দেখার শখ , বাগান দেখবো পরে । আগে দোতলার ঘর গুলো ঘুরে দেখি গিয়ে ।"
" আজ্ঞে নিয়ম নেই " - দরোয়ান বলে ওঠে এসে , সবাই চমকে তাকায় । অস্মিতা মুখ গম্ভীর করে তাকায় । বলে -" কেন , নিয়ম নেই কেন ?" দরোয়ান বলে -" ওই ঘরগুলো রাজাবাবুর হুকুমে আজ ও বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে । আপনারা বরং বাগান টা ঘুরে দেখুন , তারপর কলকাতা ফিরে যান । আমি দোতলার ঘর খুলে দিতে পারবো না , ক্ষমা করবেন ।"
দশবন্ধু মিলে বাগান ঘুরে দেখে । তারপর বাসের হর্ন শোনা যায় । ড্রাইভার দাদা এসে গেছে । ওরা জিনিসপত্র গুছিয়ে বাসে ওঠে । তখন দুপুর ১ টা ।
বাসে উঠে সকলে আনন্দে গান গাইতে যাবে , তখন টগর আর নীলা গত রাতের ঘটনা খুলে বলে সবাই কে । ড্রাইভার দাদা বলে -" তোমরা খুব বাঁচা বেঁচে গেলে গো ! দরোয়ান সবাইকেই ওপরে উঠতে বারণ করে । প্রতি বছর আমি এখানে আসি তো ! লোকজন নিয়ে । তাই সব টা জানি , যারা দরোয়ানের কথা শোনে না , তারা মরে । বেচারার মুক্তি নেই , মরেও শান্তি পায়নি , রাজবাড়ি পাহারা দিচ্ছে । বড় ভালো আত্মা , কারো ক্ষতি করে না , যারা ওর কথা শোনে না , তারা মরে ! এই আর কি ?"
দশজন মেয়ে এই কথা শুনে অবাক , ভয়ে কাঁটা হয়ে বাড়ি ফেরে সবাই । স্বপ্ন নয় ,পুরোটাই সত্যি । কলকাতায় তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে । পরের দিন আবার কলেজ ।
Comments
Post a Comment