নিশুতি রাতের অতিথি (অলৌকিক কাহিনী)


 ভবভুতি বাবু একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার । শান্তিপ্রিয় নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ , বিয়ে থা করেননি । শহরতলির শেষপ্রান্তে ছোট্ট দোতলা বাড়িতে থাকেন তিনি । কাজের লোক রামু সারাদিন তাঁর দেখাশোনা করে রাত্রে চলে যায় । অবসরের দিনগুলো ভালোই কাটছে ওনার ।

একদিন হঠাৎ প্রিয় বন্ধু অনিলের চিঠি পেলেন তিনি । অনিল তাঁর ছোটবেলার বন্ধু , থাকেন কোলকাতায় ।
পিওন এসে চিঠি দিয়ে গেলো । রামু ভবভুতি বাবুর হাতে চিঠিটা দিলো । চিঠি পড়েই ভবভুতি বাবু একগাল হাসলেন । বললেন , -" অনিল টা অনেকদিন পর চিঠি দিলো । কেমন আছে কে জানে?"
ভবভুতি বাবু রামু কে বললেন -" অনিলের পরিচিত এক ব্যাক্তি দিন সাতেকের মধ্যে এখানে আসবেন । ওনার একটা কাজ আছে এখানে । দুইতিন দিন থেকে ফিরে যাবেন কাজ সেরে ।"

রামু বললে ," ভালো তো ! কয়েকদিনের জন্য আপনি একটা বন্ধু পেয়ে যাবেন । "
ভববাবু -" ওনার থাকার সব ব্যাবস্থা তৈরি রাখিস রামু , যেকোনো দিন এসে পড়বেন । যেন কোন অসুবিধা না হয় ।"
রামু -" আজ্ঞে আমি সব গুছিয়ে রাখছি । কোন অসুবিধাই হবে না । আপনার চিন্তা নেই ।"

এইভাবে আরও দুইদিন কেটে গেলো । তিনদিনের দিন রাত্রে ভববাবু অভ্যাস মতো তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া খেয়ে শুয়ে পড়লেন । রামু বাড়ি চলে গেলো । শীতের রাত । তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন ভববাবু ।
রাত্রি ১২ টার পর কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার । নিচে নেমে এলেন সিঁড়ি দিয়ে । দরজা খুলতেই -" আজ্ঞে , আমি ই কৃষ্ণধন ভট্টাচার্য ।" ছোট স্যুটকেস হাতে এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন । সাদা চুল , সাদা দাড়ি । গায়ে কালো চাদর ।হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন । 
ভববাবু -" আরে আসুন আসুন, ঘরে আসুন , আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম । অনিল চিঠিতে সব জানিয়েছে , আপনার কোন অসুবিধা হবে না ।"

কৃষ্ণধন বাবু ভেতরে এলেন - " রাত্রের ট্রেনে এলাম , একটু লেট ছিল ট্রেন টা । তাই এত দেরী হোল । এসেই আপনার ঘুম টা ভাঙ্গালাম ।"
ভববাবু -" আরে না না , এতো হতেই পারে , আপনি স্যুটকেস টা রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিন । খুব ক্লান্ত নিশ্চই , খাবার তৈরি আছে । এখন খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম করুন । কাল কথা হবে । রামু কাল এসে আপনার জামাকাপড় সব কেচে দেবে ।"
একতলার গেস্ট রুম টা কৃষ্ণধন বাবু কে দেখিয়ে দিলেন ভববাবু ।
কৃষ্ণধন -" ভব বাবু আপনি শুয়ে পড়ুন , আমি নিজেই খেয়ে নেবো , তারপর একটা লম্বা ঘুম দিয়ে একেবারে সকালে উঠবো , আড্ডা মারা যাবে তারপর । পরশু থেকে দুদিন আমার কাজ টা মিটিয়ে চতুর্থ দিন ফিরে যাবো , খুব ভালো লাগলো আপনার সাথে আলাপ হয়ে , অত্যন্ত অমাইক মানুষ আপনি ।"

আলাপ সেরে ভববাবু ওপরে উঠে গেলেন । 

রাত্রি আড়াইটা । একতলায় কৃষ্ণধন বাবু বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন । দরজা টাআস্তে করে বন্ধ করলেন । ফিরলেন দু এক ঘন্টা পর । ভব বাবু নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছেন , তিনি কিছুমাত্র টের পেলেন না ।


সকাল আট টা বাজে -
রামু বেড টি দিয়ে ভববাবু কে ডেকে তুললো । ভব বাবু চা নিয়ে সোজা নেমে এলেন নিচের বৈঠক খানা ঘরে । কৃষ্ণধন বাবু ও চা খাচ্ছেন , তিনি রামুর সাথে নিজেই আলাপ করে নিয়েছেন । রামু ওনার জামা কাপড় কেচে মেলে দিলো বারান্দায় । তারপর দুপুরের খাবার তৈরির কাজে মন দিলো ।

অনিলের নাম উঠতেই কৃষ্ণধন বাবু বললেন , " বেশীদিনের আলাপ নয় ওর সাথে , তাতেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে । কোলকাতায় এমন মানুষ পাওয়া দুস্কর । আপনারই মতো অমাইক ।"
ভবভুতি বাবু বললেন -" অনেক ছোট বেলার বন্ধুত্ব অনিলের সাথে । কর্মসূত্রে দুরে হয়ে গেলাম । দেখাই হয়নি অনেকদিন ওর সাথে । কানের সমস্যার জন্য টেলিফোন এ বেশী কথা বলিনা । চিঠিতেই যা কথা হয় ।"

কথায় কথায় দুপুর হয়ে এলো । রামু দুজনকেই খাবার ঘরে ডাকল । খাওয়া দাওয়া শেষ হলে , কৃষ্ণধন বাবু বললেন , আপনি বরং বিশ্রাম নিন , আমি জায়গা টা ঘুরে দেখি একটু , অনেক গাছগাছালি রয়েছে ।"
এই কথা বলে কৃষ্ণধন বাবু পায়ে জুতো গলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ।ভব বাবু আরামকেদারায় বসলেন একটা বই হাতে নিয়ে । রামু নিজের ঘরে গেলো ।

কখন চোখ লেগে এসেছে খেয়াল নেই , ভব বাবু চমকে উঠলেন এক সুতীক্ষ্ণ নেকড়ের চিৎকারে । শীতের দিন , সন্ধ্যা নেমে এসেছে । ডাক টা আসছে কাছের ছোট জঙ্গল টা থেকে । কানে খাটো হলেও এ হেন জোরালো ডাক স্পষ্ট শুনলেন তিনি । বললেন - " আরে , এদিকের জঙ্গলে নেকড়ে আছে বলে তো শুনিনি । কি হিংস্র ডাক" !

কিছুক্ষন পরেই কৃষ্ণবাবু বাড়ি ফিরলেন -" ভারী সুন্দর এই জায়গা টা , অনেককিছু ঘুরে দেখলাম , সবচেয়ে সুন্দর পেছন দিকের ওই জঙ্গল টা ।"
ভব বাবু -" গিয়েছিলেন নাকি জঙ্গলে ?"
কৃষ্ণ বাবু -" আজ্ঞে না , দূর থেকে দেখলাম ।"
ভব বাবু -" আসুন চা খেয়ে নি , ওরে রামু চা নিয়ে আয় ।"


নিজস্ব কিছু কাগজ পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন কৃষ্ণবাবু । রাত ৮ টায় রামু চলে গেলো খাবার তৈরি করে দিয়ে ।

" কি মশাই ব্যাস্ত আছেন?" ভববাবু এগিয়ে এলেন গেস্ট রুমের দিকে ,-" আর তো মাত্র একটা দিন , তারপর ই তো চলে যাবেন ।"
কৃষ্ণধন বাবু অল্প হাসলেন - " এই কাগজ পত্র গুলো গুছিয়ে নিলাম , কাল পরশু কাজগুলো সেরে বেরিয়ে পড়বো । খুব ভালো লাগছে এখানে , খুব যত্ন পাচ্ছি ।"
ভবভুতি বাবু হাসলেন - " বেশ বেশ , আমি রাতে একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে নি , আজকেও খেয়ে শুয়ে পড়বো , আপনি কালকের মতন খেয়ে নেবেন সময় হলে , কেমন ?"
কৃষ্ণধন -" নিশ্চই।"

রাত্রি ঠিক আড়াই টার সময় এক ই ঘটনা ঘটলো । চুপিসারে কৃষ্ণধন বাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন , ভব বাবু জানতেও পারলেন না ।


সকালে রামুর ডাকে ঘুম ভাঙলও -" ও দাদাবাবু , চা এনেছি , দরজা খোলা কেন ছিল ? কৃষ্ণধন বাবু কোথায় ?"
এমন সময় কলিং বেল বাজলো দুবার । রামু আর ভবভুতি বাবু নিচে এসে দরজা খুললেন । কিন্তু একি ? পুলিশ কেন ?
" আপনি ই তো ডঃ ভবভুতি সেন ? আমি থানা থেকে আসছি !"
" কি ব্যাপার স্যার ?" -ভববাবু জিজ্ঞাসা করলেন ।
" আজ দুদিন হোল বেশ কিছু মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন এ তল্লাট থেকে । আমরা তল্লাশি চালিয়ে শহরতলির পেছনের জঙ্গল থেকে তাঁদের আধখাওয়া রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার করেছি । কোন বুনো জন্তু তাঁদের হত্যা করেছে । জন্তুটার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগোতে এগোতে আপনার বাড়ি অবধি পৌঁছলাম । কিছু জানেন এ ব্যাপারে ?"- অফিসার প্রশ্ন করলেন ।
ভবভুতি বাবু আকাশ থেকে পরলেন - " কি সর্বনাশ , আমিও তো নেকড়ের ডাক এই প্রথম শুনলাম এই জায়গায় ।"তারপর কৃষ্ণধন বাবুর অতিথি হিসাবে আসার কথা ও  সব জানালেন অফিসার কে ।
অফিসার গম্ভীর হয়ে বললেন- " আজকের রাত টা আমাদের সবাই কে সজাগ থাকতে হবে , কিছু একটা জানা যাবেই !"

সকলে তটস্থ হয়ে রইলেন সারাদিন । ক্রমে রাত বাড়ল । জঙ্গল থেকে নেকড়ের চিৎকার আর শোনা গেলো না । অফিসার বাড়ির চারপাশ টা পুলিশ ফোর্স দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন , যদি জন্তু টাকে ধরা যায় । 
সকাল হতেই তিনি সবাইকে নিয়ে থানায় গেলেন ।" "আবার যদি কোন মানুষ নিখোঁজ হন তাহলে আবার তল্লাশি চালাতে হবে ।এখন আসি , থ্যাঙ্কস ফর ইওর কো অপারেশন ।" -অফিসার বলে গেলেন ।

ওনারা চলে যেতেই টেলিফোন টা বেজে উঠলো -" রামু ধর তো ফোন টা "- ভববাবু বললেন ।
 রামু ফোন ধরলও - " আজ্ঞে আপনার বন্ধু অনিল বাবুর ফোন । ভববাবু ফোন ধরলেন -" হ্যাঁ রে অনিল বল " , কানের সমস্যা উপেক্ষা করে কথা বললেন ভব বাবু , সবকিছুই কেমন যেনও সন্দেহজনক ঠেকছে । 
" আমি দিন সাতেকের মধ্যেই আমার বন্ধু কৃষ্ণধন কে নিয়ে তোর কাছে যাচ্ছি । চিঠি তে বলেছিলাম কৃষ্ণধন একা যাবে , কিন্তু অনেকদিন তোর সাথে দেখা নেই , তাই আমিও যাচ্ছি ওর সাথে । তাই আর চিঠি না লিখে ফোন করে নিলাম ।"
- কথা টা শুনে ভবভুতি বাবুর হাত থেকে রিসিভার টা পড়ে গেলো । তাহলে এই কদিন কি হোল ? কার সাথে কাটালেন তিনি ? কোথায় পাবেন এর উত্তর?

রহস্যের কিনারা হোল পরের দিন । অফিসার নিজে এলেন ভববাবুর বাড়িতে । -" আপনার অতিথি হিসাবে যিনি এসেছিলেন , তিনি কোন সাধারন মানুষ নন , একজন ওয়ারউলফ , এমন প্রানী যিনি নাকি মধ্যরাতে নেকড়ে বাঘে পরিনত হন । আপনার সরলতার সুযোগ নিয়ে শিকার খুঁজে নিজের খিদে মেটাতে জঙ্গলে মানুষ টেনে নিয়ে গেছে । প্রতি রাতে তিনি জঙ্গলে যেতেন, আপনার অজান্তে। তবে তিনি কে বা কোথা থেকে এলেন ? আপনার বন্ধু অনিল ও তাঁর বন্ধু কৃষ্ণধনের পরিচয় জানলেন কি করে ? সেই রহস্যের উত্তর এখন ও মেলেনি । শুনতে আজগুবি হলে ও এটাই বাস্তব! ভাগ্য় ভালো আপনাদের কোনো ক্ষতি হয়নি ।"- অফিসার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ।
ভবভুতি বাবু হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে ।


Comments

Popular posts from this blog

ONCE IN A SUNNY MORNING(Poem)

A Memorable Marriage

DEATH OF BHOKU- My Pet Parrot