রাত তখন ১২ টা ( ভূতের গল্প)
সন্ধ্যে ৬ টা থেকে আকাশ মেঘলা । রুমি পড়তে বসলেও পড়ায় আজ তার মন নেই । জানালা দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে । বৃষ্টি শুরু হোল । সামনের জানালা দিয়ে বট গাছ টা চোখে পড়ে । লম্বা লম্বা ঝুরি ।ওটা ওদের বাগানের মধ্যেই । রুমিদের বাড়ি টা খুব বড় নয় । কিন্তু বাড়ির চারপাশে অনেক টা জমি । বাগান টা আগাছায় ভরা ।সাজিয়ে রাখার লোক নেই । রুমির বাবা মা দুজনেই শহরে চাকরি করেন । এই মফস্বলের বাড়িতে দিদার সঙ্গে থাকে সে ।আয়ামাসি সকাল ৮ টায় আসেন ।দিদা কে আর রুমি কে দেখাশোনা করেন । রাত ৮ টায় চলে যান ।
রুমি আর পড়বে না আজ । বসুমাসি শাড়ি পরে রেডি । বাড়ি যাবেন । কিন্তু বৃষ্টি তে আটকে গেছেন । রুমির দিদা ঘরে এসে বলেন-" থাক না বসুন্ধরা, আজ এই দুর্যোগে বাড়ি নাই বা গেলে, থেকে জাওনা আজ ।" বসুমাসি বলেন-" না গো মাসি মা, যেতেই হবে । বাড়ি তে গাদা গুচ্ছের কাজ পড়ে আছে । রুমি আজ আর পড়বে না, আপনি বরং ওকে নিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ুন ।
রুমি বলে ওঠে- " না না বসুমাসি , আজ তুমি যেও না । কাল আমি স্কুলে যাবো না । সকাল বেলা তোমাকে পৌঁছে দেবো ।"
বসুমাসি-" ওরে পাকা মেয়ে । তুই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড় । ৮ টা বাজে । আমি ঠিক টুক টুক করে চলে যাবো ।মফস্বলের এই ঝামেলা বুঝলি ? রাত ৮ টা বাজতেই মনে হয় যেন কত রাত ! আর দেরি করবো না । চলি কেমন, টা টা ।"
আয়ামাসি জানালা গুলো ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে গেছেন । রুমি আয়ামাসি কে টা টা করে দরজায় তালা দিয়ে দিলো । দিদা বললেন-" দিদুভাই, চলো খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ি , তুমি বই পত্র গুছিয়ে নাও । এই বৃষ্টি বাদলার দিনে তুমি যেনও আবার বারান্দায় দোলনা চড়তে যেওনা । ঘরে চলে এসো ।
রুমি তার রোজকার অভ্যাস মতো বারান্দায় যেতে চাইছিল । জন্মদিনে বাবার দেওয়া বেতের দোলনা টা রুমির বড় প্রিয় । রোজ রাত্রে পড়া হয়ে গেলে রুমি ওতে দোল খায় । সারাদিন সময় পায় না । স্কুলের খুব চাপ । রুমির মা চেয়েছিলেন রুমি কে শহরের স্কুলে ভর্তি করতে । কিন্তু রুমির বাবা আর দিদা তা চাননি । তাই রুমি মফস্বলের স্কুলেই পড়ছে ।
রুমির দাদু ঠাম্মা নেই । দিদার কাছেই সে বড়ো হচ্ছে । মা আর বাবা ছুটি পড়লেই তার কাছে আসে । দিদা আর আয়ামাসি রুমি কে খুব ভালোবাসেন । তবে তাদের বাড়ি টা পাড়ার অন্য বাড়িগুলোর থেকে এক্টূ ভেতরে । বাড়ী ও বাগান দেখাশুনার জন্য লোক রাখা হয়েছিলো ,কিন্তু সে টাকা চুরি করে পালিয়ে যায় । তারপর থেকে তারা আর কাজের লোক রাখেনি ।
এই ভাবেই দিন চলছিলো বেশ । কিন্তু এই বৃষ্টির রাত টা পালটে দিলো অনেক কিছু ।
বৃষ্টি বাড়তে থাকে । রাত তখন ১২ টা । দিদা নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছেন ।রুমির ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলো । সে দিদার দিকে দেখল । মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো । আজ তো দিদা তাকে দোলনায় উঠতে দেয়নি । বৃষ্টি কী থামল ? তাহলে কি সে বারান্দায় গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখবে ?
রুমি উঠে বাথরুমে গেলো । ক্লাস ফাইভের রুমি নিজের কাজ গুছিয়ে করতে যানে । ভয়ডর নেই তার । টীভী নেই ওদের বাড়ি তে । তবে সে বন্ধুদের মুখে শুনেছে টীভী তে কার্টুন সিরিস দেখার গল্প , ভুতের গল্প । এইবার মা বাবা এলে সে বলবে একটা টীভী কিনে দেওয়ার কথা ।
রুমি বাথরুম থেকে বেড়িয়ে । বারান্দার দিকে গেলো । বারান্দায় খিল আঁটা । তবে বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে । আকাশ এখনও মেঘলা । অল্প বিদ্যুতের ঝলকানি ডেখা যাচ্ছে জানালার কাঁচ দিয়ে । বাগানে কয়েকটা গাছ ভেঙে পড়েছে ।
রুমি দরজার খিল খুলে বারান্দায় এলো । দিদা গভীর ঘুমচ্ছেন । বারান্দায় এসে সে দোলনায় বসলো , অল্প ভিজে দোলনা টা ।কিন্তু দোল খাবার আগেই দোলনা টা দুলে উঠলো যে ! কেন ? হয়তো দমকা হাওয়া , ভারি বৃষ্টি বলেই ! রুমি হথাত শরীরে কেমন একটা শিরশিরানি অনুভব করলো । একটু হাওয়া টা থামল । দোলনায় বসে দুলছে রুমি -" নাহ এবার ঘরে যাই , রাত তো ১২ টা বাজলো । বলতে বলতে সে উঠে পড়ে , বারান্দা থেকে আসতে যাবে , এমন সময় - " রুমি দরজা টা একটু খুলবি ?" কে যেন বলে স্পষ্ট গলায় - এমন অনুভুতি রুমির আগে কখনো হয়নি । আওয়াজ টা এলো কোথা থেকে ? একি পিছন ফিরে সে দেখে বারান্দার রেলিঙের ধারে বসুমাসি দাঁড়িয়ে আছেন ।স্মিত হাসি মুখে । রুমি- " একি বসুমাসি , তুমি বাড়ি যাওনি ?" এতো রাতে বৃষ্টি তে বাইরে কি করছ ? কোথায় ছিলে এতক্ষন ?"-একরাশ প্রশ্ন করে রুমি ।
বসুমাসি- "হ্যাঁ গো রুমিদিদু , বাড়ির পথেই যাচ্ছিলুম । ওপর থেকে একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়লো কাঁধে ,অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম রাস্তায় । যখন জ্ঞান ফিরল দেখি তোমাদের পাড়ার লোকজন বাগানের ধারে আমাকে শুয়ে দিয়ে গেছে । অনেক রাত তাই তোমাদের ডাকেন নি ।"
রুমি- " হ্যাঁ গো বসুমাসি , তোমার জামায় রক্তের দাগ । ডাল টা খুব বড় ছিল না?"
বসুমাসি-" তাড়াতাড়ি এসো রুমি , আমার হাত ধরো ,আমি বারান্দার রেলিং টপকে ঢুকে পড়ছি । দরজা খুলতে গেলে দিদার ঘুম ভেঙে যাবে । আজ রাতে তোমাদের বাড়ি বিশ্রাম নিয়ে কাল সকালে চলে যাবো গো , অনেক দূর যেতে হবে ।"
রুমি দেখল বসুমাসির চোখে জল । রুমি বলে- " কিন্তু কাল ডাক্তার তো দেখাতে হবে , দাঁড়াও দিদা কে ডেকে আনি ।"
বসুমাসি-' থাক না, বুড়ো মানুষ ,ওনাকে ঘুমোতে দাও ।" রুমি বসুমাসির হাত ধরতে এগিয়ে যায় । বসুমাসি অল্প হেসে হাত বাড়ায় - রুমি দুহাত বাড়িয়ে বসুমাসি কে ধরতে যায় । একটা বরফ ঠাণ্ডা অনুভুতি, তারপর-
সকাল ১০ টা -
রুমির জ্ঞান ফিরল, তাকে ঘিরে পাড়ার সব লোকজন দাড়িয়ে আছেন । দিদা মাথার কাছে বসে চোখের জল ফেলছেন । রুমি বলে- " আমি কোথায় ? কি হয়েছে আমার ? বসুমাসি , বসুমাসি কই ? বসুমাসি কে ডাক্তার দেখাতে হবে যে !"
দিদা ডুকরে কেঁদে ওঠেন , এতো দিনের কাজের লোক বসুন্ধরা , দিদা বলেন- " কতবার বলেছিলাম বসুন্ধরা , রাত টা থেকে যাও । এমন দুর্যোগে বাইরে বেরিয়ো না । শুনলে না আমার কথা ।"
রুমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে দিদার দিকে -" তবে যে কাল রাতে বসুমাসি এসেছিলো ? তারপর কি হল ?"
দিদা-" তোর বসুমাসি আর নেই রে রুমিদিদু , কাল রাতেই ..."
রুমির এবার মনে পড়ে সেই বরফ ঠাণ্ডা অনুভুতি । বসুমাসির হাত ধরেই জ্ঞান হারায় সে । তারপর আর কিছু মনে নেই । দিদা এবার রুমি কে নিয়ে বাগানে আসেন । রুমি দেখে পাড়ার লোকজন বসুমাসির নিথর দেহ টা সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে ।বসুমাসি একা থাকতো ,কেউ আসার নেই তার বাড়ি থেকে ।
হতভম্ব রুমি কে এবার সবকিছু খুলে বলেন দিদা , আর বলেন- " বসুমাসি তোকে ছেড়ে যাবার আগে একবার দেখা করে গেলো তোর সাথে । ওরে বোকা মেয়ে , তুই আর আমাকে না বলে রাতে দরজা খুলতে যাবি না । এই যদি বসু না হয়ে অন্য কারও হাত ধরতিস, তাহলে... " আবার ডুকরে কেঁদে ফেলেন তিনি ।
রুমি এবার বুঝতে পারে সবকিছু ,তার চোখেও নামে জলের ধারা , আর কিছুই যে করার নেই ।"
Comments
Post a Comment