পাথর কুটির ( অলৌকিক কাহিনী )
কি হোল তারপর ? সত্যি জানতে চান ?
সঞ্জয়ের মা জন্মান্ধ । তাই ছোটবেলা থেকেই বিশেষ এক চোখের সমস্যার শিকার সঞ্জয় । মোটা ফ্রেমের বেশি পাওয়ারের চশ্মা পরে সে । সঞ্জয়ের মা কোনওরকমে সংসারের কাজ করলেও, স্কুল ,কলেজ, কোচিং সব ই সঞ্জয় করেছে বাবার হাত ধরে ।
শহরের বড় মিশনারি স্কুলে পড়েছে সঞ্জয় । তাকে নিয়ে বাবা মা এর স্বপ্ন কম ছিল না । কিন্তু গরীব বলে বন্ধুদের কাছে আর টিচার দের কাছে কথা কম শোনেনি সে । প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পরা ছেলেটির মধ্যে কোথায় যেন আজকের যুগের ইঁদুর দৌড়ে সামিল হওয়ার ইচ্ছের অভাব । তার ভাবাবেগ, তার কল্পনাপ্রবণতা তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে বাস্তব থেকে ।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সে কথা বলে কোচিঙের স্যার এর সাথে । খুব সামান্য বেতনে ছাত্রদের পড়াশুনায় সহযোগিতা করার কাজ দেন তিনি । মাত্র দু হাজার টাকা । স্যার বলেন -" এবার মন দিয়ে কাজ শুরু কর , অভিজ্ঞতা বাড়লে বেতন বাড়িয়ে দেবো । "
মন টা খারাপ হয়ে যায় সঞ্জয়ের । মাত্র দু হাজার টাকা ! কি করে বাবার হাতে তুলে দেবে সে ?এত কম টাকা ! মুদিখানা বন্ধ হলে সংসারই বা চলবে কেমন করে ?
বাবা খবর টা শুনে বললেন -" তবু তো কিছু উপায় হোল , তারপর অভিজ্ঞতা বাড়লে টাকাও বাড়বে ।"
এইভাবেই চলতে চলতে কয়েকটা বছর কেটে গেলো । সঞ্জয় এখন দশ হাজার টাকা বেতন পায় । তার বাবার এখন অনেক বয়স । মুদি দোকান বিক্রী করে ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছেন তিনি । এই ভাবেই তিন জনের দিন চলে যাচ্ছিলো । সঞ্জয়ের এটা ভেবে ভালো লাগে যে সে কিছুটা হলেও সংসারের হাল ধরেছে সে ।
এমনই একদিন রবিবার ঘরে বসে নানান কথা ভাবছিল সঞ্জয় । এইদিন ছুটি থাকে সঞ্জয়ের । আপন মনে ঘরে বসে লেখে সে । গোবেচারা স্বভাবের ছেলে সঞ্জয় এখন একটু শক্ত হয়েছে । আরও বেশি করে মা বাবার খেয়াল রাখে সে ।
একটা রবিবার ছুটির দিন দেখে সে ঠিক করলে কাছাকাছি একটু বেড়াতে যাবে । বাবা মা কে জল খাবার খাইয়ে বেড়িয়ে পড়লো সে । আজ এক অদ্ভুত অনুভুতি ওর মনে । মন চাইছে অচেনা অজানা কোন জায়গায় ঘুরে আসতে । একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় একটু স্বাদবদল আর কি ?
সঙ্গে অল্প কিছু টাকা আর জল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সঞ্জয় । তাদের বাড়ি টা শহরের শেষ প্রান্তে । বাড়ি ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে পাশের মফস্বলের রাস্তায় চলে এসেছে সে , আর কিছুদূর যেতেই রাস্তার পাশ দিয়ে একটা খ্রিস্টানদের কবরখানা চোখে পড়লো তার । জায়গাটা সত্যি খুব নির্জন । পছন্দ হোল তার ।
ছোটবেলা থেকেই নির্জনতা প্রিয় সে ।
সঞ্জয় ভাবে-" এই খানে একটু বসি , জায়গাটা সুন্দর ।
একটু ভেতরে ঢুকে একটা পরিস্কার সমাধিবেদী বেছে নিয়ে বসলো সঞ্জয় । সমাধি টা ফুল আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো ।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে এলো । সঞ্জয় লক্ষ্য করলো ,একটু দূর থেকে একজন উনিশ কুড়ি বছরের মেয়ে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে ! সঞ্জয় অবাক হয়ে তাকে দ্যাখে ! মেয়েটিকে সে চেনে না, তাহলে ? সঞ্জয় কৌতূহলী হয়ে ওঠে । সে উঠতে যাবে এমন সময় মেয়ে টি এগিয়ে এলো তার কাছে । পরনে সাদা লম্বা জামা , দেখে তো খিস্টান বলেই মনে হয় ।
সে বলে-" কেমন আছো দাদা ? আমাকে চিনতে পারছ ?"
সঞ্জয় অবাক হয়ে যায় । এমন আলাপি মিশুকে মেয়ে সে শহরে কখনও দেখেনি । স্বাভাবিক ভাবেই সে বলে-" কে গো তুমি ? তোমাকে তো আমি কখনও দেখিনি !"
মেয়েটি হেসে বলে-" আমাকে তো সবাই চেনে । আমার নাম আলেয়া !"
সঞ্জয়-" কিন্তু বোন আমি তো তোমাকে প্রথম দেখছি । তুমি কোথায় থাকো ?"
আলেয়া-"এই তো এখন আমি এখানে । কিন্তু থাকি অনেক দূরে ।তুমি যাবে আমার বাড়ি ?"
সঞ্জয়-" কিন্তু আমাকে তো এখন বাড়ি ফিরতে হবে, মা বাবা একলা আছেন , এই ক্লান্তি কাটাতে এখানে একটু বসেছিলাম আর কি ? তোমার বাড়ি না হয় আরেকদিন"
আলেয়া-" বেশ তো তুমি আগামি সপ্তাহে এই সময় এইখানে এসো । আমি আবার আসবো ওইদিন ।"
সঞ্জয়-" কিন্তু তোমার পরিচয় ত জানা হলো না?"
আলেয়া-" জানো , আমি খুব গরীব ঘরের মেয়ে, কখন স্কুলে যাইনি , আমার কেউ নেই ,আমি জানিনা আমার বাবা মা কে ? একাই থাকি ।"
সঞ্জয়- " দুঃখ করোনা বোন , আমিও খুব গরীব ঘরের ছেলে ।উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে টিউশন করছি । বুড়ো বাবা মা আছেন বাড়ি তে । "
আলেয়া-" তুমি আমার দুঃখ বুঝলে, খুব ভালো লাগছে তাই , আমাকে নিয়ে যাবে তোমার বাড়ি ? তোমার বোন হয়ে থাকবো ওখানে ?"
সঞ্জয় এবার একটু দোটানায় পড়ে । নরম স্বভাবের জন্য কাউকেই সে না বলতে পারে না । চুপ করে আলেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
আলেয়া হেসে বলে-" বুঝেছি , তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না । আচ্ছা তুমি আজকেই আমার বাড়ি তে চলো , দূরে হলেও খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবো আমরা । সে মন্ত্র আমার জানা ।"
সঞ্জয় আরও অবাক হয়ে বলে-" তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার মন্ত্র?"
আলেয়া-" হ্যাঁ ", বলে সে সঞ্জয়ের হাত ধরে , সঞ্জয় অনুভব করে তার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে ,আলেয়া কে না বলবার শক্তি তার নেই !
তারপর কি যেন হোল ,কেমন একটা ঘোরের মধ্যে সঞ্জয় উপস্থিত হল এক লহমায়, অচেনা ধূসর এক প্রান্তরে । একে মরুভুমিও বলা জায়না, আবার গাছ গাছালিরও দেখা নেই ।
আলেয়া এবার সঞ্জয়ের হাত ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সঞ্জয় নেশাগ্রস্তের মতো পিছু পিছু চলেছে । আলেয়ার গতিপথ যেনও আর শেষ হচ্ছে না ! ক্রমশ ঘন কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে সে !
সঞ্জয় আচমকা মনের বল ফিরে পায় ! নাহ, আর এগোবেনা সে । মা বাবা কে একলা ফেলে কোথাও গিয়ে তার শান্তি নেই । তাই সঞ্জয় চেঁচিয়ে দাকে, -" আলেয়া !!! লক্ষী বোন আমার, আমাকে বাড়ি যাবার পথ বলে দাও । আমার বাবা মা "
আলেয়া-"আমার সাথে তুমি অনেক দূরে চলে এসেছ সঞ্জয়দা, এখন আর ফিরে যাবার রাস্তা নেই ।সামনে এগোতেই হবে ।"
সঞ্জয়-" কিন্তু, এমন কথা তো ছিলোনা বোন , তুমি বলেছিলে আমার বাড়ি যাবে , তারপর জোর করে আমাকে, " ডুকরে কেঁদে ওঠে সঞ্জয়।
আলেয়া-" আমার এটাই কাজ সঞ্জয়দা , আমি সবার জীবনে আসি । নেহাত তুমি সৎ, নির্লোভ মানুষ, তাই ফিরে যাবার শক্তি ফিরে পাবার চেষ্টা করছ !কিন্তু মনে রেখো ,তুমি আর তোমার দেহ এখন আলাদা ,এখন তুমি জীবন বৈতরণীর কিনারায় এসে দারিয়েছ, পৃথিবী তে ফিরে গিয়ে আর লাভ হবে না, যে পৃথিবীর কথা তুমি ভাবছ, সেই পৃথিবী তোমার বসবাসের উপযুক্ত নয়।"
সঞ্জয়-" কিন্তু আমি তো এতো তাড়াতাড়ি মরতে চাইনা আলেয়া , আমার কি দোষ ছিল বল ?আমাকে দাদা বলে ডেকে কেন এমন করলে?"
আলেয়া-" আমি যখন আসি, তখন কি রূপে আসি তা কেউ জানতে পারে না , ওই দেখো আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে, তোমার পূর্বসূরি রা তোমাকে দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে !"
সঞ্জয় দেখে অপূর্ব এক আলোর রেখা, দূরে...
এবার ধীরে ধীরে পা বাড়ায় সে । মাটির টান তুচ্ছ বলে মনে হয় , ব্যাস ,সব শেষ। তার পূর্বপুরুষ দের আত্মারা গ্রহন করে তাকে । এদিকে পৃথিবীর কবরখানায় সমাধিবেদীর ওপর পড়ে থাকে সঞ্জয়ের নিথর দেহ ।
পরদিন সকাল থেকে সঞ্জয়দের পাড়ায় হুলুস্থুল কাণ্ড । সঞ্জয়কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ।সঞ্জয়ের বাবা মা বুক চাপড়ে কা৺দছে-"এ কি হোল ?"
না, সঞ্জয়ের আর পৃথিবী তে ফেরা হয়নি । বরং তার বাবা ও মা এক সপ্তাহের মধ্যেই ছেলের শোকে প্রান ত্যাগ করেছেন । আনন্দের খবর এটাই যে সঞ্জয় কে ছেড়ে বেশিদিন তাদের থাকতে হয়নি, হয়তো আলেয়াই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে সেই দুনিয়ায়, যেখানে তাদের সন্তান তাদের জন্য অপেক্ষারত।
যে শহরে তারা বাস করত, সেখানকার মানুষজন মুখ বেঁকিয়ে বলে-" টাকা নেই, পয়সা নেই , কেবলা কান্ত ছেলের জন্য কেঁদে কেঁদে বূড়োবূড়ী কান ঝালাপালা কোরে দিলে । ভালো হয়েছে পুরো বংশ লোপ পেয়েছে । এঈ পৃথিবী আমাদের , পিছিয়ে পড়া মানুষদের কোণও স্থান নেই এখানে ।"
এবার আপনারাই বলুন , আমার সহৃদয় বন্ধুগণ , তাহলে কী রকম পৃথিবী তৈরি করবো আমরা ? যেখানে
সঞ্জয়ের মতো ছেলেরা বাঁচবে তাদের পরিবার নিয়ে ? নাকি টাকা আর উচ্চশিক্ষার জোরে অন্য আরেক দল মানুষ ছড়ি ঘোরাবে তাঁদের ওপর ?
মৃত্যুর পর ই বা কোথায় স্থান হবে তাদের ? পরলোক কেই কী শেষ আশ্রয় হিসাবে মেনে নিতে হবে চিরকাল ? নতুন কোনও দিব্য পৃথিবীর আরাধনা কি সম্ভব হবে? নাকি আলেয়াই হবে আমাদের শেষ ভরসা ? আর পৃথিবী হবে "পাথর কুটির "! ইতিহাসে লেখা থাকবে " প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা?"
Comments
Post a Comment