বিল্টুর কুকুর (ভৌতিক কাহিনী)
বিল্টুর বাড়ি পাইকপাড়া তে । সে রোজ স্কুলে যাবার সময় পাড়ার সব কুকুরদের বিস্কুট খাওয়ায় । ক্লাস এইটের ছেলে বিল্টু । পড়া শুনায় সে বিশেষ সুবিধা করতে পারে না ।তার মন খালি পশুপাখি দের দিকে ।পশু পাখি দের চিকিৎসার ভার নিতে চায় সে । আহত পশু পাখি দের বাড়ি তে তুলে আনে , সেবা করে।
বেশ বড় বাড়ি বিল্টু দের।রাস্তার ওপরেই । বিল্টুর বাবা ডাক্তার । বাড়ি তে ঠাকুমা , দাদু , কাকা , কাকিমা সবাই আছেন ।বিল্টুর মা বিল্টু নিয়ে বড়ই চিন্তিত । ছেলের যে পড়া শুনায় মন একেবারেই নেই । দিন রাত পশু পাখি দের সেবায় ব্যাস্ত। তবে বিল্টুর বাবা কিন্তু ছেলে কে বেশি বকাবকি করেন না । তিনি ডাক্তার মানুষ । মনে মনে তিনি চান বড় হয়ে বিল্টু পশুপাখি দের ডাক্তার হোক । এত যার পশুপ্রেম ! সে কি অন্য পাঁচটা ছেলের মত বইতে মুখ গুঁজে থাকবে সারাদিন ?
স্কুল থেকে এসে রোজ খেলতে যায় বিল্টু। তবে ওর খেলা মানুষের সাথে নয় , পশু পাখি দের সাথে । পাইকপারায় বিল্টুর বাড়ির কাছে একটা ভেটরিনারি হাসপাতাল আছে । তার মানে হোল পশু চিকিৎসালয় । তার লাগোয়া মাঠেই খেলতে যায় সে । যে সব কুকুর , বিড়াল , গরু মাঠে চরে বেরায়, যাদের দেখার কেউ নেই , তাদের নিয়েই চিন্তা বিল্টুর ।বাবার কাছ থেকে অসুধ নিয়ে অসুস্থ পশুপাখি দের খাওয়ায় সে । হাসপাতালের মাঠের ঝিল টা তে অনেক পাখি আসে । বিল্টু ওদের দানা খাওয়ায় ।
এইভাবেই দিন কাটছিল । কিন্তু একদিন মাঠে খেলতে গিয়ে সে শুনতে পায় বাচ্চা কুকুরের কান্না । এদিক ওদিক তাকায় সে । কান্নার আওয়াজ টা আসছে বট গাছের ওপারে ঝোপের ভেতর থেকে । বিল্টু এগিয়ে যায় । কাঁটা ঝোপের নিচে একটা সাদা তুলতুলে কুকুর ছানা । একা ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে শুয়ে কাঁদছে । গায়ে কাঁটা ফুটে অল্প রক্ত বেরিয়েছে । বিল্টু আর ঠিক থাকতে পারে না । ছোট্ট কুকুর টাকে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ি তে আসে । একটা কাঠের বাক্সের ভেতর কাপড় পেতে শুয়ে দেয় ওকে ।
বিল্টু ভাবে , কুকুর টার মা কি করে ফেলে গেলো এত সুন্দর কুকুর ছানা টাকে ? বাবার থেকে অসুধ আর তুলো এনে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয় সে । নিজের ঘরের এক কোনে গরম কাপড় চাপা দিয়ে রেখেছে ওকে । গরম দুধ মা বিল্টুর জন্য নিয়ে এলে বিল্টু খাওয়ায় ছানা টাকে । এইভাবেই সবার অজান্তে সে একরাত কাটিয়ে দেয়।
স্কুলের জন্য পরের দিন রেডি হচ্ছে বিল্টু । এবার তাকে মা এর কাছে সব কিছু খুলে বলতে হবে । কুকুর ছানা টা সারাদিন একা থাকবে । তাই সে আর দেরি না করে বাবার চেম্বারে ছুটে যায় । মা বাবা কে জলখাবার দিচ্ছিলেন । সে সব কথা খুলে বলে । দু চোখ ভরে জল তার ।বিল্টুর কথায় মা বাবা হেসে বলেন -" ওরে কিসের চিন্তা , আমরা তো আছি , এমন কাণ্ড তুই আগেও করেছিস , এখন নিশ্চিন্তে স্কুলে যা , ওর কোন অযত্ন হবে না । তুই ফিরে এসে ওকে সুস্থ দেখবি রে !" বিল্টু কান্না ভুলে হেসে ওঠে , স্কুলে চলে যায় ।
স্কুলে সারাদিন সে কুকুরটার কথাই ভাবে । দু একবার স্যার বকুনিও দেন অন্যমনস্ক হয়ে বলে । কিন্তু বিল্টুর দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে । সে বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে । অঙ্কে ভালো সে । কিন্তু আজ অঙ্কের ক্লাসে ও বকুনি জুটল তার কপালে ।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আর কোনোদিকে তাকায় না সে । সোজা নিজের ঘরে চলে আসে । সেখানে ঢুকেই এক বিরল দৃশ্যের মুখোমুখি হয় সে । বাবা কুকুর টাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছেন । কুকুরটা এখন অনেকটা সুস্থ ।একটা ছোট বল নিয়ে সামনের পা দিয়ে খেলছে সে ।
বিল্টু বেজায় খুশি । ছানা টার সে নাম দেয় লাট্টু , বিল্টুর সাথে মিলিয়ে । লাট্টু এখন থেকে ওদের বাড়ি তেই থাকে । বিল্টুর সারাদিন ওকে নিয়েই কাটে । তবে অন্য পশুদের ভোলে নি সে । বিকালে মাঠে গিয়ে দেখা শোনা করে আসে ওদের ।
লাট্টু বাড়ি তে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে , দিব্যি খেলে বেড়ায় সারা বাড়ি । সবাই আদর করে । একমাস হোল সে এসেছে । দেখতে বেশ বড় হচ্ছে দিনকে দিন । এমন সুন্দর সাদা লোম ওয়ালা কুকুর কোলকাতায় খুব কম দেখা যায় । মনে হয় যেন পাহাড়ি এলাকা থেকে আনা ।
এইভাবেই দেখতে দেখতে একবছর কেটে গেলো । বিল্টু আর লাট্টু অবিচ্ছেদ্য বন্ধু । একে অন্য কে ছেড়ে থাকতে পারে না , হরিহর আত্মা । একদিন বাগানে বিল্টু গাছ লাগাচ্ছে , হঠাৎ মা এসে বললেন-" জানিস বিল্টু, লাট্টু কে সারা বাড়ি তে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ! ও কি তোর সাথে আছে রে?" বিল্টু চমকে ওঠে -" কই না তো , আমি তো এসেছি গাছ লাগাতে, লাট্টু তো ঘরেই ছিল !"
সারা বাড়ি তে খোঁজ খোঁজ রব , বিল্টু সোজা চলে যায় পশু হাসপাতালের মাঠে , কি জানি কি মনে করে , বিল্টু সেই ঝোপটার কাছে যায় । যেখান থেকে লাট্টু কে সে কুড়িয়ে পেয়েছিলো । এদিক ওদিক দেখতে থাকে ।নাহ এখানেও আসেনি । সে লাট্টু কে নিয়ে খেলতে আসতো এই মাঠটায় , তাই খুঁজতে এলো এখানেই ।
এখন প্রায় সন্ধ্যে, কিন্তু , কই লাট্টু তো এখানেও নেই , শুধু ঝোপের ধারে গাছের গায়ে চাকা চাকা রক্তের দাগ ! আধো অন্ধকারে দেখতে পেলো বিল্টু । " রক্ত কেনো ?" সে ভাবে মনে মনে । সেই একবছর আগে লাট্টু কে কুড়িয়ে পেলো , তখন কাঁটা গাছের গায়ে এমন রক্তের দাগ দেখেছিলো সে । বুক টা ছ্যাঁত করে উঠলো বিল্টুর , "কোথায় গেলো লাট্টু ?" মনমরা হয়ে বাড়ি ফেরে সে ।
নিজের ঘরে এসে হাত পা ছেড়ে কাঁদতে থাকে বিল্টু। বাড়ির সবাই বিলতু কে ঘিরে রইলো সেই রাত টা । নাহ , সারা বাড়ি তে লাট্টু কোথাও নেই ! ডুকরে ডুকরে কাঁদে বিল্টু । সারা রাত সবাই এক ঘরে- শোকের ছায়া নামে বাড়ি তে । এই ভাবেই আরও দু একদিন কেটে যায় ।
তিনদিন পরেও লাট্টু নিখোঁজ । সেদিন রাতে বিল্টু বসেছিল অঙ্ক নিয়ে , মনকে ভোলানোর জন্য , কিন্তু রাত দুটো অবধি সে জেগে থাকে , সারা বাড়ি নিস্তব্ধ, নিশুতি রাত , কোথাও কোন শব্দ নেই । অঙ্ক করতে করতে সে হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে । কুই কুই করে কাঁদছে লাট্টু ! হ্যাঁ লাট্টুর গলা , এই আওয়াজ তার খুব চেনা । দৌড়ে বারান্দায় আসে বিল্টু । শীতের রাত , বাগানে একটাই আলো জ্বলছে ।কিন্তু একি ? বাগানের দেওয়ালে ও কার ছায়া ? " লাট্টু উউউউ !" চেঁচিয়ে ওঠে বিল্টু। তিনতলার ঘরের বাইরে লোহার বাঁকানো সিঁড়ি দিয়ে সোজা বাগানে আসে বিলতু । বাগানের দেওয়ালে লাট্টুর ছায়া । চারিদিকে লাট্টু কোথাও নেই , শুধু ছায়া টাই মুখ তুলে কেঁদে চলেছে ! কিছু যেন বলছে বিল্টু কে ! সে অদ্ভুত এক অনুভূতির শিকার হয় !
সে আরও দেখে - লাট্টুর পেছনে আর একটা বড় কুকুরের ছায়া , লাট্টু কাঁদছে আর হাঁটছে , বড় কুকুরের ছায়া টা নিশ্চুপ ভাবে ভেটরিনারি হাসপাতালের মাঠের দিকে চলে গেলো , লাট্টুর ছায়া টাও তাকে অনুসরন করছে । কান্নার আওয়াজ টা তখন ও থামেনি । বিল্টু কাউকে না বলে বাগানের বাইরে রাস্তায় আসে । তারপর ছায়া দুটো কে অনুসরন করতে করতে সোজা চলে আসে হাসপাতালের মাঠে ! তারপর -
ছায়া দুটো সেই ঝোপে গিয়ে মিলিয়ে গেলো ।বিলতুর চমক ভাঙ্গে হঠাৎ ,রাত তখন ২ টো । ঝোপের গায়ে যেখানে রক্ত লেগে ছিল বিলতু সেখানে দাঁড়িয়ে এখন । আশে পাশে কোন লোকজন নেই । রাস্তা দিয়ে একটা লরি চলে যায় । লরির হেড লাইটের আলোয় বিল্টু নিজের পায়ের কাছে এক টুকরো কাগজ দেখতে পায় । কাগজ টা চার ভাঁজ করা । হাতে নিয়ে খুলে সে দেখে তাতে লাট্টুর পায়ের রক্তমাখা ছাপ ! কাগজ টা আর অন্য কিছু নয় , তার অঙ্কের খাতার একটা পাতা ।
"এসব কি হোল ?" এইবার বিল্টু নিজেকে সামলাতে পারে না । " লাট্টু ফিরে আয় " বলে চেঁচিয়ে কাঁদে ! " ঘেউউউউউউ" করে হিংস্র একটা কুকুর ডেকে ওঠে ! সঙ্গে লাট্টুর কান্না , মাঝরাতে মাঠে সে একা ! এই অবস্থায় কি করবে বিল্টু ? না, সে এই রহস্যের কিনারা না করে বাড়ি ফিরবে না ।খুব সাহসী ছেলে বিল্টু । লাট্টু কে হারাবার কথা ভাবতে পারে না সে । এইভাবেই সময় কেটে যায় । আর কোন আওয়াজ বা ছায়া দেখতে বা শুনতে পায়না সে । ভোর ৪ টে বাজতেই হাসপাতালের দরজা খুলে যায় । তখনই বিলতু এসে গেট কিপার কে সব কথা খুলে বলে ।
গেট কিপার বলে ," খোকা তুমি জানো না?" " তিন চার দিন আগে রকি মারা গেছে যে !"
"রকি কে ?" বিল্টু জিজ্ঞাসা করে ।
" রকি তো সেই সাদা কুকুর টা , যে একবছর আগে এখানে ভর্তি হোল , তারপর সেদিন মারা গেলো , খুব ভুগছিলও । তুমি যে লাট্টু কে পুষেছিলে সে তো রকিরই বাচ্চা । রকি একবছর আগে কয়েকটা সুন্দর বাচ্চার জন্ম দেয় । বড়লোকের কুকুর । বাচ্চা গুলো কে ওরা বিক্রী করে দিয়েছে । শুধু একটা বাচ্চা নিয়ে যাবার সময় ঝোপের মধ্যে ফেলে গিয়েছিলো ওরা । সেই তো তোমার লাট্টু ছিল গো ।"
"তুমি কি করে জানলে এত কথা ?" বিল্টু বলে ।
"জানি গো জানি , রকির আত্মা এসেই তোমার লাট্টু কে নিজের কাছে নিয়ে গেলো গো ! তবে লাট্টু তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়নি । তাই তার রক্ত মাখা পায়ের ছাপ রেখে গেছে তোমার জন্য ! ওদের কেই কাল দেখেছো তুমি ।"
সব শুনে বিলতু কেমন উদাস হয়ে যায় । আর কোন কথা বলতে পারে না । সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় । তখন ভোর সাড়ে চারটে । অন্ধকার কাটেনি ।
বিল্টু বাড়ির দিকে রওনা হতেই গেট কিপার মুচকি হেসে মিলিয়ে গেলো । বিলতু পেছন ফেরেনি আর । সে জানতেই পারলো না যে গেট কিপার হাসপাতালের কেউ নয় । সে আসলে রকির মালিকের ড্রাইভার । মারা গেছে রকির প্রতিশোধের আগুনে । বাচ্চা কেড়ে নেওয়ার অপরাধে শুধু নিজের মালিক কে নয় , রকি হত্যা করেছে মালিকের ড্রাইভার কেও । প্রতি হিংসার জ্বালা যাবে কোথায় ?
সব রহস্য গুলো কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছিলো না ? এবারে সব জলের মত পরিস্কার । বিল্টু বাড়ি ফিরতে ভোরের আলো ফুটল একটু করে । লাট্টুর দুঃখে শরীর আর চলছে না । এতো কাণ্ডের মধ্যে সে ভুলেই গেছে যে হাসপাতালের গেট খোলে ভোর ৬ টায় । এই সময় টাকে সে মনে রাখবে সারা জীবন ।
নিঃশব্দে বাড়ি তে ফিরে লাট্টুর পায়ের ছাপ লাগা কাগজ টা বুকে আগলে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো বিল্টু । বাড়ি তে সবাই তখনো শীতঘুমে আচ্ছন্ন ।
Comments
Post a Comment